বরিশাল জেলা মানেই কেবল নদী–খাল–বাওড় আর শস্যের মাঠ নয়—একসময় এই অঞ্চল ছিল পূর্ববঙ্গের অন্যতম বড় শিক্ষা ও সংস্কৃতি-কেন্দ্র। এই জনপদের মাটিতে জন্ম নেওয়া বা যাদের শেকড় এখানে প্রোথিত ছিল, এমন বহু মানুষ পরবর্তীকালে ভারতের মাটিতে দাঁড়িয়ে সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র, রাজনীতি, অর্থনীতি ও বুদ্ধিবৃত্তিক জগতে অসাধারণ ভূমিকা রেখে গেছেন। তাঁদের এই সাফল্যগাঁথা শুধু ব্যক্তিগত অর্জনের গল্প নয়—এ এক ইতিহাস, যেখানে স্থানান্তরের বেদনা, স্বদেশচ্যুতির যন্ত্রণা এবং নতুন মাটিতে নিজেদের পুনর্গঠনের দীর্ঘ সংগ্রাম লুকিয়ে আছে।
১৯৪৭ সালের উপমহাদেশ বিভাজন ছিল বরিশালের ইতিহাসেও এক ভয়াবহ অধ্যায়। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে স্বাধীনতা এলেও তার সঙ্গে সঙ্গে এলো বিভাজনের নির্মম পরিণতি। ধর্মের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ফলে পূর্ববঙ্গ যুক্ত হলো পাকিস্তানের সঙ্গে, আর পশ্চিমবঙ্গ থেকে গেল ভারতের অংশে। এই রাজনৈতিক বিভাজন রাতারাতি পরিবর্তন করে দিল মানুষের পরিচয়, নাগরিকত্ব ও ভবিষ্যৎ। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলো, জীবন আর সম্পত্তির নিরাপত্তা বিপন্ন হয়ে উঠলো, বন্ধ হয়ে গেল সামাজিক স্বাভাবিকতা। বরিশালের মতো এলাকায়—যেখানে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ছিল তুলনামূলক বেশি—সেই ভয়াবহতা আরও প্রকট হয়ে উঠেছিল। ফলে হাজার হাজার পরিবার অজানাকে আলিঙ্গন করে ভারতে পাড়ি দিলেন।
বরিশাল থেকে মানুষের এই প্রথম বড়সড় স্রোত দেখা যায় ১৯৪৬ থেকে ১৯৫২ সালের মধ্যে। এরপর ১৯৬৪ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দ্বিতীয় ঢেউয়ের জন্ম দেয়। আর ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পূর্ববঙ্গের বহু মানুষ আবারও ঘর ছাড়তে বাধ্য হন। এই প্রবাসযাত্রা কোনো স্বেচ্ছাচারিতার ফল নয়, ছিল জীবন বাঁচানোর তাগিদ। কেউ গেছে সন্তানের ভবিষ্যৎ রক্ষায়, কেউ গেছে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে, কেউ গেছে শুধু বেঁচে থাকার জন্য।

এই বিশাল জনস্রোতের সঙ্গে বরিশাল হারিয়েছিল তার অনেক শ্রেষ্ঠ সন্তানকে। তবু সেই মানুষগুলো নতুন দেশে হারিয়ে যাননি—বরং নতুন মাটিতে নিজেদের শক্ত করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। আধুনিক বাংলা কবিতার পথিকৃৎ জীবনানন্দ দাশ তার উজ্জ্বল উদাহরণ। বরিশালের বাকেরগঞ্জে জন্ম নেওয়া এই কবি দেশভাগের পর কলকাতায় আশ্রয় নেন। তাঁর কবিতার প্রতিটি লাইনে ফিরে ফিরে আসে বরিশালের প্রকৃতি—ধানক্ষেত, নদীর জল, পাথরের পাখি, নির্জনতা। যেন আজও তাঁর আত্মার একটি অংশ পড়ে আছে কীর্তনখোলার তীরে।

ঠিক একইভাবে, নাট্যকার ও অভিনেতা উৎপল দত্ত বরিশাল থেকে কলকাতায় গিয়ে ভারতীয় রাজনৈতিক থিয়েটারের এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। তাঁর নাটকে উঠে আসে শ্রমিকের কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, সাধারণ মানুষের সংগ্রাম। রবীন্দ্রসংগীতের শান্ত আবহ থেকে তিনি তৈরি করেন প্রতিবাদের মঞ্চ। তিনি হয়ে ওঠেন একাধারে শিল্পী ও আন্দোলনের মানুষ।

বরিশালের আরেক সন্তান জহর রায় হয়ে ওঠেন ভারতে বাংলা সিনেমার জনপ্রিয় কৌতুক অভিনেতা। তাঁর হাসিতে মানুষ আনন্দ পেয়েছে, কিন্তু সেই হাসির আড়ালেই হয়তো চাপা পড়েছিল এক উদ্বাস্তু মানুষের দীর্ঘশ্বাস। অভিনেত্রী ও পরিচালক অরুন্ধতী দেবী কলকাতায় গিয়ে চলচ্চিত্রে নারীর নতুন ভাষা তৈরি করেন। তিনি শুধু অভিনয় করেননি, ক্যামেরার পেছনেও দাঁড়িয়েছেন, নারী নির্মাতাদের পথ করে দিয়েছেন সাহসে ও দক্ষতায়।

বরিশালের সন্তান দুলাল গুহ বলিউডে গিয়ে ধর্মেন্দ্রের মতো নায়ককে ‘অ্যাকশন হিরো’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর হাত ধরেই গড়ে ওঠে এক নতুন ধারার হিন্দি সিনেমা। অন্যদিকে মিঠুন চক্রবর্তী—যার পারিবারিক শেকড় বরিশাল অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত বলে বহু সূত্রে উল্লেখ পাওয়া যায়—কলকাতার ইন্ডাস্ট্রির কাঁচা পাট থেকে শুরু করে বলিউডের সুপারস্টার হয়ে ওঠেন। নাচ, অ্যাকশন আর স্টাইল দিয়ে তিনি বদলে দেন ভারতের বাণিজ্যিক সিনেমার ভাষা।

রাজনীতিতেও বরিশালের ভূমিকা কম নয়। পশ্চিমবঙ্গের সাবেক মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য ছিলেন বরিশালের পারিবারিক উত্তরাধিকারবাহী মানুষ। আর প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও রাজনীতিক অশোক মিত্র ছিলেন বরিশালের এক জমিদার পরিবারের সন্তান, যিনি পরবর্তীকালে ভারতের রাষ্ট্রনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

কেন বরিশালেই এই স্থানান্তরের হার বেশি ছিল? কারণ এ জনপদ ছিল শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত, সংস্কৃতিতে পরিপক্ব, কিন্তু সংখ্যালঘু মানুষের বসতি বেশি। দাঙ্গা শুরু হলে প্রথম আঘাত এসেছিল এখানেই। আর শিক্ষিত মানুষই আগে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝে স্থানত্যাগ করেছিলেন।

তাঁরা কেউই বরিশালকে ভুলে যাননি। কেউ নদীর নাম বদলাননি কবিতায়, কেউ মাটির গন্ধ সরাননি গানে বা সংলাপে। বরং সেই শেকড়কেই শক্ত করে ধরে রেখেছিলেন নতুন ভূমিতে টিকে থাকার জন্য। এভাবেই বরিশাল হারায়নি—শুধু ছড়িয়ে গেছে।
বরিশাল তাই কেবল একটি জেলার নাম নয়—এটি এক সংস্কৃতি, এক মানসিকতা, এক পরিচয়ের নাম। আজ ভারতের কবিতা, নাটক, সিনেমা কিংবা রাজনীতির যে উজ্জ্বল অধ্যায়গুলো আমরা দেখি, তার বহু পৃষ্ঠা রচিত হয়েছিল এই বরিশালের মাটিতে দাঁড়িয়ে। শেকড় বদলায়নি, ঠিকানা বদলেছে শুধু।
